ফিরে দেখা–

মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারেনা ও বন্ধু…
এই বিখ্যাত গানটি আমরা সকলেই কম বেশি শুনেছি। কিন্তু গানের মধ্যে থাকা ছোট্ট এই দুই লাইনের গভীরতা কতটুকু তা হয়ত সকলে অনুধাবন করতে পারি না। যাই হোক মূল কথায় আসি, ২০১০ সালের আগস্ট মাসের ২০ তারিখ কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমার বড় খালামনির অপারেশনের জন্য বি পজেটিভ (B+ve) ব্লাডের প্রয়োজন ছিল। দিনটি ছিল ঈদুল আযহা তথা সরকারী ছুটির দিন। যার ফলে অনেক চেষ্টা করেও ব্লাড ডোনার পাওয়া যাচ্ছিল না। সর্বশেষ সন্ধানী কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ ইউনিট এর অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করি।

সেখানে এক ব্যাগ ব্লাডের বিনিময়ে আরেক ব্যাগ দেওয়ার নিয়ম। নিজেদের পরিবারের কেউ কখনো ব্লাড দেওয়াতে অভ্যস্ত ছিলো না। তাছাড়া অনেকেই ব্লাড দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ছিলো না। অন্যদিকে রক্তের অনেক প্রয়োজন। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অবশেষে সন্ধানীতে আমি প্রথমবারের মত ব্লাড ডোনেট করি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ৯ বার (২০ আগষ্ট ২০১৭ পর্যন্ত) স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছি এবং যতদিন আল্লাহ তায়ালা সুস্থ রাখেন ততদিন রক্তদান করবো ইন শা আল্লাহ।

যে কথা বলছিলাম, রক্তদানের সময় প্রথমে বেশ ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু রক্ত দান করার পর নিজের ভেতর যে প্রশান্তি কাজ করেছে তা কোনদিন বলে বোঝানো সম্ভব নয়। যাই হোক সেদিন বুঝেছি রক্তদানের মত এমন একটি মহৎ কাজ আর হয় না। সেই চেতনাকে কাজে লাগিয়ে আমার প্রিয় ক্যাম্পাস চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-আমিন একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজ এর বন্ধুদেরকে সাথে নিয়ে কোন সংস্থা কিংবা সংগঠন ছাড়া নিজেরা রক্ত দিতাম এবং অন্যদেরকে রক্তদানে উৎসাহিত করতাম, ডোনার লিষ্ট সাথে রাখতাম, একটা সময় মানুষকে সহযোগীতার কারনে আমার মোবাইল নম্বর সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিনিয়ত রক্তের জন্য ফোন আসা শুরু করে। নিজের সাধ্য অনুযায়ী সকলকে সহযোগীতার চেষ্টা করতাম আমরা।

কিন্তু এক পর্যায়ে একাডেমীর বন্ধুরা জীবনের টানে সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়ে যায়। সঙ্গত কারণে চাঁদপুর সরকারী কলেজ, প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে হয় আমাকে। সবাই চলে যাওয়ার কারনে আমি একা হয়ে পড়ি। আর একা একা রক্তদানের বিশাল কাজ সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে! কিন্তু কাজ তো আর থেমে থাকে না। প্রথম দিকে নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোষ্ট করার সাথে সাথে রক্ত ব্যবস্থা হয়ে যেতো অতপর এভাবেই রক্তদান কর্মসূচী চলতে থাকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত।

প্রতিষ্ঠার পটভূমি:-
২০১০ থেকে ২০১৬ শেষ করতে করতে এরই মাঝে আমার সাথে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে চাঁদপুর সরকারী কলেজ, প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের ছোট-বড় ভাই-বোন এবং সকল শিক্ষকদের সাথে। প্রিয় ডিপার্টমেন্ট এর সকল কাজে সব সময় সক্রিয় থাকার কারনে সকল শিক্ষক বৃন্দ আমাকে আদর করতো নিজের সন্তানের মত এবং প্রত্যেক বর্ষের এমন কোন ছাত্র-ছাত্রী ছিলো না যারা আমাকে চিনতোনা অথবা আমি তাদেরকে চিনতাম না। শুধু চেনা জানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, বরং সময় পার হওয়ার সাথে সাথে সম্পর্ক হতে লাগলো আরও গভীর। বিভিন্ন সময় আড্ডা দেওয়া, গল্পকরা, ভ্রমন করা এসব ছিলো নিত্য দিনের কর্মসূচী। গল্পের এক পর্যায়ে রক্তদান নিয়ে কথা ওঠে। তখন আমি একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখি আমার আদরের ছোট দুই ভাই যারা আমার আপন ভাই থেকে কোন অংশে কম ছিলোনা।

সে দুজন হচ্ছে- মু. নাঈম হোসেন পাঠান (২০১৩-১৪ শিক্ষা বর্ষ) এবং শেখ ফরিদ আহমেদ শাওন (২০১৪-১৫ শিক্ষা বর্ষ)। তাদের প্রস্তাব দেওয়ার সাথে সাথে তারা আমাকে সহযোগীতা করার আশ্বাস প্রদান করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে থেকে কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে বাছাই করি, তারা হচ্ছে- (২০১৩-১৪ শিক্ষা বর্ষের) নুরুন নাহার প্রীতি, মু.আদনান হোসেন, (২০১৪-১৫ শিক্ষা বর্ষের) আব্দুল্লাহ্ আল-নোমান, অলোক দাস, ফারজানা আখতার রিকা, নাঈমুল ইসলাম সুজন, মু. ফরহাদ পাটওয়ারী, (২০১৫-১৬ শিক্ষা বর্ষের) নাজমুল হাসান রাহুল, (২০১৬-১৭ শিক্ষা বর্ষের) আব্দুস সালাম রনি, (২০১৭-১৮ শিক্ষা বর্ষের) মো.হান্নান খান শান্ত, গৌতম সরকার, মু. ইয়াছিন পাটওয়ারী প্রমুখ।

বাছাইকৃত সকলের সমর্থন নিয়ে সংস্থার জন্য অভিভাবক ঠিক করি, যিনি চাঁদপুর রয়েল হাসপাতালের পরিচালক- জনাব, বি এম হারুনুর রশিদ। যেহেতু আমাদের কাজগুলো রোগী তথা অসহায় মানুষকে নিয়ে সেহেতু হাসপাতালের পরিচালনায় থাকায় তাঁর কাছ থেকে এ ব্যাপারে ভাল সহযোগিতা এবং পরামর্শ পাওয়া যাবে। এমন চিন্তা থেকে উনাকে অভিভাবক হিসেবে বাছাই করি। আনন্দের বিষয় হচ্ছে আমরা যতটা আশা করেছি জনাব, বি, এম হারুনুর রশিদের কাছে তার থেকে হাজার গুণ বেশি ভূমিকা রেখেছেন এ সংস্থার জন্য। শুধু এতটুকুই বলবো ‘অনুসন্ধানী’-র সামনের পথ চলায় তার ভূমিকা অতুলনীয়।

তারপর প্রিয় অভিভাবক সহ আমরা কয়েকজন বসে সংস্থার নাম ঠিক করলাম। আমার প্রস্তাবনায় এবং জনাব, হারুনুর রশিদ, নাঈম পাঠান, শেখ ফরিদ এর সম্মতি ক্রমে সংস্থার নাম দেওয়া হয় ‘অনুসন্ধানী রক্তদান সংস্থা বাংলাদেশ’ পরবর্তীতে উপস্থিত সকলকে নিয়ে এবং কিছু ছোট ভাই-বোনদেরকে নিয়ে একটি সাধারন সভার আয়োজন করা হয় এবং সে সভায় সর্বসম্মতি ক্রমে উক্ত নামটি গৃহীত হয় এবং নতুন সংস্থা পরিচালনার জন্য সভায় আমার প্রস্তাবনায় এবং সকল সদস্যদের সম্মতি ক্রমে একটি পূর্নাঙ্গ পরিচালনা পরিষদ কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটির সদস্যরা হচ্ছে যাথাক্রমে
(১) চেয়ারম্যান :- বি.এম. হারুন উর রশিদ (২) ভাইস চেয়ারম্যান :- খন্দকার আতিকুর রহমান সাগর (৩) ব্যবস্থাপনা পরিচালক :- মু. শহীদ উল্যাহ (বাবর) (৪) সাংগঠনিক সম্পাদক :- মু. আল আমিন (৫) সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক :- মু. আদনান হোসেন (৬) দপ্তর সম্পাদক :- মু. নাঈম হোসেন পাঠান (৭) সহ-দপ্তর সম্পাদক :- আব্দুস সালাম রনি (৮) অর্থ সম্পাদক :- শেখ ফরিদ আহমেদ শাওন (৯) প্রচার সম্পাদক :- মু. আব্দুল্লাহ্ আল-নোমান (১০) সহ-প্রচার সম্পাদক :- গৌতম সরকার (১১) অনলাইন বিষয়ক সম্পাদক :- নাঈমুল ইসলাম সুজন (১২) সহ-অনলাইন বিষয়ক সম্পাদক:- মু. ফরহাদ পাটওয়ারী (১৩) মহিলা বিষয়ক সম্পাদক :- নুরুন নাহার প্রীতি (১৪) সহ-মহিলা বিষয়ক সম্পাদক :- সাবিনা আক্তার (১৫) পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক :- নাজমুল হাসান রাহুল (১৬) সমাজকল্যাণ সম্পাদক :- অলোক দাশ (১৭) তথ্য ও গবেষনা সম্পাদক :- হান্নান খান শান্ত (১৮) কার্য্যকরী সদস্য:- কাজী মু. মুজ্জাম্মেল হক (১৯) কার্য্যকরী সদস্য:- মু. রাশেদ পাটওয়ারী (২০) কার্য্যকরী সদস্য:- বাবুল হোসেন (২১) কার্য্যকরী সদস্য:- মু. হাবীবুর রহমান (২২) কার্য্যকরী সদস্য:- আব্দুল জাব্বার আল-বান্না (২৩) কার্য্যকরী সদস্য মু. ইয়াছিন পাটওয়ারী।

মূলত তখন থেকে ”রক্ত ঋণ – রক্ত দিন” এই স্লোগানকে সামনে নিয়ে সংস্থার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু।

যাদের অবদান স্মরণীয় থাকবে:-
শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তথা আজীবন সংস্থা যাদের কাছে ঋণী থাকবে তাঁরা হচ্ছেন- ১। জনাব মো: শওকত ইকবাল ফারুকী সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ চাঁদপুর সরকারী কলেজ, চাঁদপুর। ২। জনাব মো: সেলিম হোসেন সহকারী অধ্যাপক প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ চাঁদপুর সরকারী কলেজ, চাঁদপুর। ৩। জনাব, সেলিনা পারভীন প্রভাষক, প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ চাঁদপুর সরকারী কলেজ, চাঁদপুর। ৪। জনাব, সঞ্জয়কুমার সাহা প্রভাষক, প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ চাঁদপুর সরকারী মহিলা কলেজ, চাঁদপুর। ৫। জনাব, মো: নাজির উল্যাহ মজুমদার প্রভাষক, প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ চাঁদপুর সরকারী কলেজ, চাঁদপুর। ৬। জনাব, ওবায়েদ উল্যাহ্ ভূলন সম্পাদক ও প্রকাশক- সিএনএন বি ডি২৪.কম ৭। জনাব, সাইফুল ইসলাম সিফাত সম্পাদক- প্রিয় চাঁদপুর। ৮। জনাব, জাহিদুল হক মিলন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, চাঁদপুর। ৯। জনাব, মো: আনিছুর রহমান সহকারী শিক্ষা অফিসার, কচুয়া, চাঁদপুর। ১০। জনাব, জেসমিন সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, দুয়ারীপাড়া সরকারী কলেজ, রুপনগর, ঢাকা, ১১। জনাব, টি মাহাবুব প্রমুখ।
যারা সব সময় বুদ্ধি-পরামর্শ, উৎসাহ প্রদান, অর্থনৈতিক এবং শারীরিক পরিশ্রম করে সংস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহযোগীতা করেছেন।

কিছু কথা সকলের জন্য:-
প্রিয় স্বেচ্ছাসেবী ভাই-বোনেরা, শুভাকাঙ্ক্ষী , পরিচালনা পরিষদ, উপদেষ্টা পরিষদ, রক্তদাতা-রক্তগ্রহীতা তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ব্যানারে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী বৃন্দ। চাঁদপুর সরকারী কলেজ প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এই সংস্থাটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিনা পয়সায় দেশের সকল প্রান্তে মানুষদেরকে রক্তদান করা তথা একটি মহৎ ও কল্যানমুখী উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘অনুসন্ধানী রক্তদান সংস্থা বাংলাদেশ। এ কল্যানমুখী সংগঠনটি কোন রাজনৈতিক দল, কোন নির্দিষ্ট ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী কিংবা কোন ব্যক্তির নয়, এটি মানবতার কল্যানকামী সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ, অসহায় রোগী, অসহায় বাবা-মা যারা রক্তের জন্য নিজের সন্তানকে বাঁচাতে মানুষের দ্বারে দ্বারে যায়, হাজার হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী, তথা প্রতিনিয়ত রক্ত গ্রহীতা ভাই-বোনদের কল্যানের জন্য তথা এই দেশের মানুষের জন্য এই সংগঠনটি। আমি অনুরোধ করবো এ সংস্থাকে সহযোগীতা না করতে পারলেও এ সংস্থার ক্ষতি হোক এমন কোন কাজ কেউ করবেন না। এই সংস্থাটি অন্য কোন সংস্থার সাথে প্রতিযোগিতার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি কিংবা কারো প্রদর্শন করার ব্যানার হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এটি শুধু মাত্র মানব কল্যানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানবতার সেবা করবে এ ওয়াদা বাস্তবায়নে বদ্ধ পরিকর। আমি চাই সকল তরুন সমাজ মিলে দেশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়, গ্রামে শহরে এ ধরনের ছোট-বড় সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক এবং মনবতার পাশে থাকুক এবং এ সংস্থাকে সাথে নিয়ে কাজ করুক।

পরিশেষে বলবো,
আমরা মানুষ। মানুষ হিসেবে আমাদের ভুল থাকতেই পারে। কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। আমি সকলের কাছে আবারো বিনীত ভাবে অনুরোধ করবো সুন্দর পরামর্শের মাধ্যমে আমাদের ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন এবং আমি সহ এ সংস্থার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য যারা রয়েছেন তারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেও এ সংস্থার কার্যক্রম যাতে বন্ধ না হয়ে যায় এ অনুরোধ পরবর্তী প্রজম্ম তথা সকল স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে। সর্বশেষ মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি এ সংস্থাকে মানব কল্যানের জন্য কেয়ামত পর্যন্ত কবুল করুন, আমীন।

লেখক-
মু.শহীদ উল্যাহ্ (বাবর)
বি.এস-সি (সম্মান) এম.এস-সি (প্রাণিবিজ্ঞান) এল.এল-বি (জা.বি)
প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
অনুসন্ধানী রক্তদান সংস্থা বাংলাদেশ।
তারিখ- ২৭ আগষ্ট ২০১৭ খ্রীঃ